আবুল হায়দার তরিকঃ সময়টা তখন ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধিদের বিচার চলছিলো। এই দিন রায় হলো কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ড। অথচ একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধী কাদের মোল্লার অপরাধ ছিলো ৬টি, তার মধ্যে ৫ টি প্রমাণিত হয়। তার মধ্যে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা সহ আলুব্দি গ্রামের ৩৪৪ জন মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, গণহত্যা উল্লেখ যোগ্য।
এই রায়ে কাদের মোল্লার প্রতিক্রিয়া ছিলো বিজয় চিহ্ন প্রদর্ষন। তার মানে এই রায়ে সে সন্তুষ্ঠ হয়েছে। যা দেশের সচেতন প্রজন্ম মেনে নিতে পারে নি। এতো গুলো হত্যা, ধর্ষণ, গণহত্যা, ও মানবতা বিরোধী অপরাধের শাস্তি শুধুমাত্র যাবজ্জীবন কারাদন্ড! তা মেনে না নিয়ে দেশের আপামর জনসাধারন এবং প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, লেখক/ব্লগার রাজধানী ঢাকার শাহবাগ মোড়ে জড়ো হতে থাকে।
শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। অল্প সময়ে তা ছড়িয়ে পরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। জায়গায় জায়গায় মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ, অবস্থান কর্মসূচিসহ আন্দোলনে মুখরিত হয় সারাদেশ। গণজাগরণ মঞ্চের এ আন্দোলনে তরুণ প্রজন্ম বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো।
৫ ফেব্রুয়রির এ আন্দোলনের সময় শাহবাগ চত্বরে অনেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে কাদের মোল্লার ফাসির দাবী করেনে। সেই সময় শাহবাগ মোড়কে অনেকে প্রজন্ম চত্বর বলেও ডেকেছেন।
আন্দোলনের ধরণঃ গনজাগরণমঞ্চের আন্দোলনের প্রকৃতি ছিলো ভিন্নধর্মী। আন্দোলন কারীরা আন্দোলনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলো স্লোগান, গান, কবিতা, নাটক ইত্যাদি। স্মরণ করা হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও বীর শহীদদের। স্মরণ করা হয়েছে একাত্তরের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারক শহীদ জননী ও লেখিকা জাহানারা ইমামকে।
এসময় শাহবাগ থেকে টিএসসি-র মোড় পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশের দেয়াল গুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছবি এঁকে জনতার সাথে সংহতি প্রকাশ করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবী জানায়।
তাদের দাবী গুলোর মধ্যে ছিলো- কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্ব্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সকলকে সর্ব্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান বয়কট করা।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াঃ কোদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলনে দেশের মুক্তিযোদ্ধের চেতনা লালনকারী মানুষদের একত্র করতে সহায়তা করে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দু-এক জন নেতাও গনজাগরণ মঞ্চের দাবীর সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। ব্লগার, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা আন্দোলনের ডাক দিলে সারা দেশের মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। ঢাকা, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর ছাড়াও জেলা এবং ইউনিয়ন লেভেলে এ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়।
এই আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয়। কাদের মোল্লার ফাঁসীর রায়ে ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগ অসন্তুষ্ট হয়। তাদের নেতা কর্মীরা এ আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে। বিএনপি প্রথম দিকে নিরব ভূমিকায় থাকলেও আন্দোলনের অষ্টম দিন আন্দোলনের সাথে এস সংহতি প্রকাশ করে। কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ, সাসদ, জাতীয় পার্টি, সহ সকল দল এ আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে। একমাত্র জামাত-শিবির এ আন্দোলনের বাহিরে থেকেছে।
ইউনিভার্সিটি অব ট্রমসো, নরওয়ে-এ বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ
এছাড়াও বিশ্ব প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতেও শাহবাগের আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা বাঙ্গালীরা এ আন্দোলনের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করে। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও এ আন্দোলনের রাস ছড়িয়ে পরে।
জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরের ভূমিকাঃ বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির এ আন্দোলনের বিরোধীতা করে। তারা তাদের নেতাদের বাচানোর জন্য দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরী করে। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে মাঠে নামে। চালায় শাপলা চত্বরের তান্ডব।
মূলত জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের সমর্থন করেছিলো। জামায়াতে ইসলামী একটি পাকিস্তানী রাজনৈতিক দল, তখনকার তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ এখন ছাত্রশিবির নামে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের নেতাকর্মীদের মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার একাধিক প্রমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাব্যুনাল গঠণের পর থেকে তার বিরোধীতা করা দলটি শাহবাগের আন্দোলন বানচাল করতে নানা চেষ্টা চালিয়েছে এমন খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, জামায়াতে ইসলামী আন্দোলন বানচাল করতে দেশের বাহিরেও বাধা-বিপত্তি তৈরী করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জামাতের নিবন্ধন বাতিল করে। ফলে তারা গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ এর নির্বাচনে অংশ নিতে পারে নি। তবে বিএনপির জোটের মধ্যে ছিলো।
শাহবাগ চত্বরে আন্দোলনের ফলাফলঃ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে রাষ্ট্র পক্ষের আপিল করার দাবী জোরদার করায় সরকার সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির বিধান রেখে আইন সংশোধন করে। মন্ত্রীসভা এতে নীতিগত অনুমোদন দেয়। ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ সালের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাশ হয়। এর মধ্য দিয়ে আসামী পক্ষের পাশাপাশি রাষ্ট্র পক্ষও আপিল করার সমান সুযোগ পায়।
এরপর ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর আপিল বিভাগ আব্দুল কাদরে মোল্লার অপরাধ গুলো পূন বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসীতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।