বর্তমানে ঢাকায় এমন কোনো মোড় নেই, যেখানে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা মোটরসাইকেল চালকের দেখা মিলবে না। অন্যদিকে ঢাকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বাদে সব রাস্তা আর মোড়ে দেখা মিলবে পায়ে নয়তো ব্যাটারিচালিত রিকশার।
বর্তমানে ঢাকায় এমন কোনো মোড় নেই, যেখানে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা মোটরসাইকেল চালকের দেখা মিলবে না। অন্যদিকে ঢাকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বাদে সব রাস্তা আর মোড়ে দেখা মিলবে পায়ে নয়তো ব্যাটারিচালিত রিকশার। ছোট ছোট এসব যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহনের কারণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব বাহনের চালকরা জোটবদ্ধ হয়ে মাঝেমধ্যেই নানা দাবি-দাওয়া আদায়ে সড়কে বিক্ষোভ-অবরোধও করেন। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে রয়েছে এ ধরনের বাহন। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বর্তমানে ঢাকায় যত যানবাহন চলছে, তার ৪৯ শতাংশ মোটরসাইকেল এবং রিকশা-ভ্যানের মতো অযান্ত্রিক বাহন (সড়ক পরিবহন আইনে ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার মতো বাহন ‘মোটরযান’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত নয়)।
ঢাকার জন্য সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) হালনাগাদ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে এ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। ‘আপডেটিং দ্য রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ফর ঢাকা’ শীর্ষক প্রকল্পের অংশ হিসেবে সমীক্ষাটি পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে সমীক্ষাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। সমীক্ষার তথ্য বলছে, ঢাকার রাস্তায় চলাচলরত মোট যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলের হিস্যা ২৭ শতাংশ। রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ির মতো অযান্ত্রিক বাহনের পরিমাণ ২২ শতাংশ। ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার) ২০ শতাংশ। থ্রি-হুইলার ১৪ শতাংশ। মাইক্রোবাস, পিকআপের মতো মোটরযান আছে ৭ শতাংশ। ট্রাকের পরিমাণ ৬ শতাংশ। ঢাকায় চলাচলরত মোট যানবাহনের মাত্র ৩ শতাংশ বাস। অন্যান্য যানবাহন রয়েছে আরো ১ শতাংশ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ২২ লাখ ৩৮ হাজার। যদিও এর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এখন আর চলাচল করে না।
মোটরসাইকেল, রিকশা, প্রাইভেট কার, থ্রি-হুইলারের মতো যানবাহন ঢাকার সড়কের বেশির ভাগ দখলে রাখছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। সড়ক দখলের পাশাপাশি এসব যানবাহন ট্রাফিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলাও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকার সিংহভাগই ছোট গাড়ি। যত গাড়ি, তত ড্রাইভার। বিপুলসংখ্যক এ চালকগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন কাজ। ছোট ছোট এসব যানবাহনকে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা যায় না। আবার এ চালক গোষ্ঠী সড়কে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবেও কাজ করে, যাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা প্রশাসন ক্ষেত্রবিশেষে অসহায় হয়ে যায়। ছোট ছোট যানবাহনের পার্কিংও কোনো নিয়মের মধ্যে থাকে না। এতেও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।’
নগরবাসীর দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য বাসের মতো বড় যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো ঢাকার পরিবহন সমস্যার সবচেয়ে বড় সমাধান হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছোট গাড়ি রিপ্লেস করে বড় গাড়ি নামানোর কথাটি নতুন কিছু নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। সরকারের নানা সমীক্ষায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। যদিও ছোট গাড়ি রিপ্লেস করে বড় গাড়ি নামানোর কার্যকর উদ্যোগ আমার চোখে পড়ছে না।’
ঢাকায় বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের আধিক্য বেড়েছে গত এক দশকে। আরএসটিপি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ঢাকায় মোট যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলের হিস্যা ছিল ১১ শতাংশ। বর্তমানে এ হার ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাহনটির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে রাইডশেয়ারভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থার জনপ্রিয়তা। গত ১০ বছরে (২০১৫-২০২৪) শুধু রাজধানী ঢাকায় সাড়ে আট লাখের বেশি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ। একই সময়ে দেশজুড়েও বেড়েছে দুই চাকার বাহনটির সংখ্যা।
মোটরসাইকেলের সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে দুর্ঘটনা। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত মার্চে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ নিহত হয়েছে, তার ৪১ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।
ঢাকায় নিবন্ধিত যান্ত্রিক বা মোটরচালিত যানবাহনের হিসাব সরকারের কাছে থাকলেও রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ির মতো অযান্ত্রিক যানবাহনের কোনো পরিসংখ্যান নেই। সড়ক পরিবহন আইনে ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার মতো বাহন ‘মোটরযান’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় সেগুলোর কোনো সরকারি হিসাব নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রের দাবি, ঢাকায় শুধু রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশার মতো যানবাহন রয়েছে ১৬ লাখের বেশি। এসব যানবাহন ঢাকার রাস্তায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলাচল করছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার রাস্তায় অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এসব রিকশা-অটোরিকশা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের আরেক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অনুমোদনহীন ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা আসা শুরু হয় ২০১০ সালের পর। সে সময় বিআরটিএর টাইপ মডেল অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের যানবাহন দেশে কীভাবে প্রবেশ করল? পরবর্তী সময়ে স্থানীয়ভাবে সংযোজন, উৎপাদন শুরু হলো কোন প্রক্রিয়ায়? আজকে শুধু ঢাকায় প্রায় ১৬ লাখ রিকশা, অটোরিকশা ঢুকল কীভাবে? আসলে এ পরিস্থিতির জন্য মূলত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড, বিআরটিএর মতো সংস্থাগুলো দায়ী। এ সংস্থাগুলোর অবহেলার কারণে রিকশা-অটোরিকশার মতো যানবাহনের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রাজধানী ঢাকাকে দিন দিন জঙ্গলে পরিণত করছে।’
ঢাকার রাস্তা থেকে মোটরসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশার মতো ছোট ছোট যানবাহন অল্প সময়ে সরানো সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চাইলেও রাতারাতি এসব বাহন সরাতে পারব না। এসব যানবাহন রাস্তা থেকে সরিয়ে নিরাপদ ও উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন করতে চাইলে সরকারকে অনেক কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার আগে প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন, নীতিমালা তৈরি করতে হবে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।’
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার সড়কে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় সবচেয়ে আলোচিত বাহনটির নাম ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা। এসব যানবাহন ঢাকায় গণপরিবহনের প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। মোটরসাইকেলও ঠিক একইভাবে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এসব বাহন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মত দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়টি নিয়ে আমাদের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। বুয়েটকে দিয়ে আমরা ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার একটি নিরাপদ মডেল তৈরি করছি। এ ধরনের রিকশা নিবন্ধন দেয়ার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। আমরা পর্যায়ক্রমে বর্তমানের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে নিরাপদ অটোরিকশা দিয়ে রিপ্লেস করব এবং এসব যানবাহনের বিচরণক্ষেত্র নির্ধারণ করে দেব।’ ঢাকায় ছোট যানবাহনের পরিবর্তে উন্নত ও আধুনিক বাস প্রবর্তনের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।