চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। চলতি মাসের শুরুর দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও বিশ্লেষক আল–জাজিরাকে এ খবর জানিয়েছেন।
সূত্রগুলো বলছে, বৈঠকে নিজের তৃতীয় পুত্রকে উত্তরসূরি করতে পুতিনকে অনুরোধ করেছিলেন কাদিরভ। কিন্তু কাদিরভের তৃতীয় পুত্র উত্তর ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্রটির নেতা হোক, পুতিনের তা পছন্দ নয়।
দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে পুতিনের ‘পদাতিক সৈনিক’ বা অনুগত ব্যক্তি বলে দাবি করে আসা কাদিরভ চলতি মাসের শুরুতে বলেছেন, ‘আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাই।’
কাদিরভ ৭ মে পুতিনের সঙ্গে ওই একান্ত বৈঠক করেন। এর আগে ক্রেমলিনপন্থী সংবাদমাধ্যম চেচনিয়া টুডেকে কাদিরভ বলেছিলেন, ‘নতুন (চেচেন নেতা) নিজের মতামত, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসবেন। আমি আশা করি, আমার অনুরোধ গ্রহণ করা হবে।’
ক্রেমলিনে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করার সময় কাদিরভ বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনে চেচনিয়ার ৫৫ হাজার সেনা লড়াই করছেন।’ পাশাপাশি চেচনিয়ায় নিজের শাসনামলে অর্জিত নানা অর্থনৈতিক সাফল্যের দীর্ঘ তালিকাও পড়ে শোনান তিনি। মুসলিম–অধ্যুষিত চেচনিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ।
বক্সিং ও ওজন উত্তোলন-সংক্রান্ত খেলাধুলায় আগ্রহী কাদিরভ তাঁর অর্জনগুলো একটি কার্ডে বড় অক্ষরে লিখে পড়ে শোনান। তবে বৈঠকে পুতিন বা কাদিরভ কেউই পদত্যাগ প্রসঙ্গ তোলেননি। এক দিন পর কাদিরভ নিজেই বিষয়টি পরিষ্কার করেন এবং বরাবরের মতো পুতিনের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পরদিন মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে কাদিরভ লেখেন, ‘আমি যা–ই বলি না কেন, যতই অনুরোধ করি না কেন, সিদ্ধান্ত নেন শুধু একজন (পুতিন), তিনি আমাদের সর্বোচ্চ কমান্ডার।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আমি একজন পদাতিক সৈনিক। নির্দেশ এলে আমি তা পালন করি মাত্র।’ নিজের শাসনামলে চেচনিয়ায় পুতিনের নামে অনেক সড়ক ও জেলার নামকরণ করেছেন কাদিরভ।
কাদিরভ সরকারের ভেতরের কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন, চেচনিয়ার এমন সূত্র আল–জাজিরাকে জানিয়েছে, প্রকাশ্যে বিনয়ের ভঙ্গি থাকলেও পুতিনের সঙ্গে কাদিরভের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর তৃতীয় পুত্র আদম কাদিরভকে পছন্দ না করার বিষয়টি ঘিরে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। গত নভেম্বরে আদমের বয়স ১৭ বছর হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নথিভুক্ত তথ্য থেকে জানা যায়, চেচনিয়ায় ভিন্নমতের ওপর দমন–পীড়ন এবং কাদিরভবিরোধী লোকজন ও তাঁদের আত্মীয়দের ওপর নির্যাতন করার প্রমাণ রয়েছে। মূলত এ কারণেই সূত্রগুলো নাম প্রকাশ করতে সম্মত হয়নি।
সূত্রগুলোর একটির মতে, পুতিন কাদিরভের ছেলেকে এই চেচেন নেতার উত্তরসূরি হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
২০২৩ সালে রমজান কাদিরভ একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। এতে তাঁর ওই ছেলেকে একটি বন্দিশিবিরে এক রুশ নাগরিককে মারধর করতে দেখা যায়। ওই রুশ নাগরিকের বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর অভিযোগ ছিল।
রমজান কাদিরভ তখন বলেছিলেন, তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে ‘গর্বিত’। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সিদ্ধান্ত ছিল, বয়সের কারণে তাঁর (ছেলের) বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ আনা যাবে না।
আদম কাদিরভকে চেচনিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের প্রধানসহ বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটি সূত্র বলেছে, তাঁকে ‘রাজপুত্রের’ মতো করে বড় করা হয়েছে। ফলে বাস্তব জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা সীমিত।
চেচনিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, ৩০ বছরের নিচে কেউ প্রজাতন্ত্রটির প্রধান হতে পারেন না। ২০০৪ সালে নিজের বাবা আখমাতের হত্যাকাণ্ডের সময় রমজানের বয়স ছিল ২৮ বছর।
আখমাত ছিলেন মুফতি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। চেচনিয়ার সুফি ঐতিহ্যকে প্রত্যাখ্যান করা কঠোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে তিনি হাত মিলিয়ে ছিলেন। তবে দীর্ঘ সংঘাতের পর তিনি অবস্থান বদল করেন।
বোমা বিস্ফোরণে আখমাত নিহত হওয়ার পর বয়সের কারণে রমজান কাদিরভ ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেননি। ২০০৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে চেচনিয়ার নেতা হন। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়টাতে অন্যরা প্রজাতন্ত্রটির শাসনক্ষমতার শীর্ষে থাকলেও তিনিই ছিলেন কার্যত নেতা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রমজান কাদিরভ পদত্যাগ করলে বা শারীরিক কারণে তাঁকে সরে যেতে হলে আদম কাদিরভ চেচনিয়ার নেতা হতে পারবেন না। সংবিধান অনুযায়ী চেচনিয়ার নেতা হতে হলে তাঁকে আরও ১২ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ২০৩৭ সালে তাঁর বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হবে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, রমজান কাদিরভ নেক্রোটাইজিং প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত। এটি অগ্ন্যাশয়ের একটি গুরুতর রোগ। এতে অঙ্গটির কিছু অংশ পচে বা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তীব্র পেটব্যথা, সংক্রমণ ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গ বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রোগটি প্রাণঘাতীও হতে পারে। এ ছাড়া ৪৮ বছর বয়সী কাদিরভের কিডনির সমস্যাও রয়েছে। এ জন্য তাঁকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়।
আল–জাজিরাকে কয়েকটি সূত্র বলেছে, রমজান কাদিরভকে গুরুতর অবস্থায় একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি চেচনিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী গ্রোজনির আইমেড ফ্যামিলি ক্লিনিকে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে অবস্থান করেন। প্রায়ই সেখানে রাত কাটান।
সূত্রগুলো বলেছে, কাদিরভ একসঙ্গে নিজের কাজকর্মের অনেকগুলো ভিডিও ধারণ করে রাখেন। পরে পূর্বে ধারণকৃত এসব ভিডিও ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হয়। এসব তিনি এ জন্যই করেন, যাতে জনগণকে নিজের দৈনন্দিন কাজ সম্পর্কে (মিথ্যা) একটি ধারণা দেওয়া যায়।
সূত্রগুলোর এসব দাবি আল–জাজিরা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করে দেখতে পারেনি। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও একই ধরনের দাবি করেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, চলমান অসুস্থতার কারণে রমজান কাদিরভ বিভিন্ন অলিখিত নিয়ম ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন।
পবিত্র রমজান মাসের শেষে টেলিভিশনে চেচেনবাসীর উদ্দেশে শুভেচ্ছা বক্তৃতা দেওয়া রমজান কাদিরভের অন্যতম অলিখিত নিয়ম। কিন্তু গত মার্চে পবিত্র রমজানের শেষে তিনি এ নিয়ম রক্ষা করেননি। দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো তিনি এমনটি করলেন।
এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি চেচেনদের মধ্য এশিয়ায় জোরপূর্বক স্থানান্তরের স্মরণ অনুষ্ঠানেও অংশ নেননি রমজান কাদিরভ। ১৯৪৪ সালের ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিনের আদেশে পুরো চেচেন জনগোষ্ঠীকে ‘জাতিগত শুদ্ধি’ অভিযানের অংশ হিসেবে মধ্য এশিয়ায় জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। প্রতিবছর ২৪ ফেব্রুয়ারি চেচেনরা ওই মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে শোক ও স্মৃতিচারণা করেন।
চেচনিয়ার অভ্যন্তরীণ খবর প্রকাশ করা টেলিগ্রাম চ্যানেল নিসোর আনসার দিশনির মতে, কাদিরভ নিজের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘খুব উদ্বিগ্ন’।
আনসার দিশনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ক্রেমলিন যে তাঁর (কাদিরভ) পরিবারকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সবকিছু বদলে যেতে পারে। কারণ, পুতিন নিজেও তো স্থায়ী কেউ নন।’
সূত্রগুলো বলেছে, রমজান কাদিরভের উত্তরসূরি হিসেবে এ পর্যন্ত ৫১ বছর বয়সী চেচনিয়ার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা আপতি আলাউদিনোভ ক্রেমলিনের পছন্দের শীর্ষে রয়েছেন।
আলাউদিনোভ চেচেনদের মধ্যে একটি পরিচিত নাম। বিশেষ করে যাঁরা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার হয়ে লড়াই করছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু সেখানে তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলো যুদ্ধের কিছু ‘বানোয়াট’ ভিডিও তৈরি করে কিছুটা তামাশার খোরাকে পরিণত হয়েছে।
আল–জাজিরার আগের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলাউদিনোভের নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলো ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি। তারা ইউক্রেনে মোটাদাগে রাশিয়ার অধিকৃত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, অনেক বছর ধরেই রমজান কাদিরভ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে সম্পত্তি ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। এর মাধ্যমে নিজের পরিবারের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। কাদিরভের ঘনিষ্ঠদের অনেকেও একই পথে হেঁটেছেন।
দুবাইয়ের রুশভাষী আবাসন খাতের এক প্রতিনিধি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘চেচেনরা আমাদের সেরা ক্রেতাদের অন্যতম। তাঁরা নগদ অর্থ নিয়ে আসেন।’
তিন দশক আগে চেচনিয়ায় চরম দারিদ্র্য ছিল। তখন অপহরণ–হত্যাসহ নানা অপরাধের কারণে অঞ্চলটি বিচ্ছিন্নতাবাদের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
মানবাধিকার সংস্থা ‘নরওয়েজিয়ান হেলসিঙ্কি কমিটি’র জ্যেষ্ঠ নীতিনির্ধারক আইভার দালে বলেন, একসময় কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন, রুশ ফেডারেশনের অংশ হওয়ার কারণে চেচনিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়া ঠেকানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।’
দুটি যুদ্ধ ও দীর্ঘ সময় ধরে উত্তর ককেশাস অঞ্চলে ‘চরমপন্থা’বিরোধী সশস্ত্র অভিযান শেষে চেচনিয়া এখন রাশিয়ার সবচেয়ে সুবিধাভোগী প্রদেশে পরিণত হয়েছে।
মস্কো গত কয়েক দশকে চেচনিয়ায় কেন্দ্রীয় তহবিলের বন্যা বয়ে দিয়েছে। রমজান কাদিরভ এসব তহবিলে অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি রাজকীয় ও অত্যন্ত সুরক্ষিত বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বিলাসবহুল স্পোর্টস কারের তাঁর বিশাল সংগ্রহ রয়েছে, যা নিয়ে তিনি দম্ভ করে থাকেন। নিজের জন্মদিনে বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মাইক টাইসনসহ পশ্চিমা তারকাদের জনসমক্ষে নৈপুণ্য প্রদর্শন করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রমজান কাদিরভ।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো কাদিরভ ও তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দলের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ এবং সন্দেহভাজন ‘চরমপন্থীদের’ সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ তুলেছে।
আইভার দালে মনে করেন, চেচনিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল ও রাশিয়া-অধিকৃত ইউক্রেনের অংশেও পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।