কৃষিবিদ গোলাম রব্বানী; বিগত সরকারের সময়কার এই দাপুটে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই! যার নিয়ন্ত্রণে ছিলো অধিদপ্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে যৌথভাবে পরিচালিত ওই প্রকল্পটির প্রতিটি ধাপে রয়েছে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির স্পষ্ট ছাঁপ।
প্রাণীসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের মোট বাজেট ছিলো চার হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।
বিগত সরকারের সময় বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ ঘনিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাকে ‘হরিলুটের’ এই প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রকল্প পরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের লোক হওয়ায় মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন কৃষিবিদ গোলাম রব্বানী। তিনি ছিলেন এই প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (সিটিসি), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও; তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে রাজধানীতেই।
দেশের পার্বত্য তিন জেলা ছাড়া সকল জেলা, উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা ছিলো এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত। প্রানিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো, মার্কেট লিংকেজ ও ভেলু চেইন সৃষ্টি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ প্রানিজ খাদ্য উৎপাদন, গবাদি পশুর উৎপাদন ২০ শতাংশ বৃদ্ধি, প্রাণিবীমা চালুকরণসহ একগুচ্ছ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য ট্যাব সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয় গোলাম রব্বানীর ঘনিষ্ট নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠানকে। অত্যন্ত নিম্নমানেরসেসব ট্যাব বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দরে কেনা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ ট্যাব অকেজো হয়ে পড়ে আছে। যার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন গোলাম রব্বানীসহ আরো কয়েকজন।
একই প্রকল্পের জন্য ডিজাইন সুপারভিশন ফার্ম নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যথাযথ দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে ডিজাইন প্রস্তুতির দায়িত্ব দেয়া হয়। যার ফলে নির্ধারিত সময়মতো স্লটার হাউজ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বাতিলও হয়ে গেছে।
প্রকল্পের পশুখাদ্য ক্রয়ের টেন্ডারেও রয়েছে গুরুতর অনিয়ম। সরকার নির্ধারিত ৩৮ টাকা কেজির খাদ্য ৭২ টাকা দরে কেনা হয়েছে। এই চুক্তি সম্পাদনের সময় কোনো ধরনের ডিপিপি অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।
গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ বা এফএমডি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ৩৭০ কোটি টাকা ব্যায়ে অপর একটি প্রকল্প আছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১০০ কোটি টাকার এফএমডি ভ্যাকসিন ক্রয় করা হয়েছে। আরও ১০০ কোটি টাকার ভ্যাকসিন ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কিন্তু এরপরেও আবার এলডিডিপি প্রকল্পের অধীনে এমএফডি ও ছাগলের পেস্টি ডেস পেটিটস ইন রুমিন্যন্ট বা পিপিআর ভ্যাকসিন কেনা হয়। যার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট নথি থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় উপজেলা, জেলা, খামার বা বিভাগীয় দপ্তরে আনুসঙ্গিক ঘাসচাষ, জ্বালানী ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে কোটি কোটি টাকা অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ ওইসব খাতে রাজস্ব বাজেট থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এলডিডিপির মাধ্যমে ঘাষ চাষের প্রমাণও পাওয়া যায় না।
অভিযোগ রয়েছে, এলডিডিপির অসাধু কর্মকর্তাদের একটি অংশ চুক্তি করেই পঞ্চাশ শতাংশ নিয়ে আসে। স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর (এলজিইডি) থেকে প্রকল্পে একজন প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ চার বছরে তাকে কোন কমিটিতে রাখা হয়নি বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।
ডিজি-৫২ নং প্যাকেজে এফএমডি ভ্যাকসিনেশন পোগ্রাম বাস্তাবায়নের জন্য সিরিঞ্জ, নিডেল, কুলবক্স ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর দরপত্র আহ্বান করা হয়। পাঁচজন ঠিকাদার দরপত্র ক্রয় করে দুইজন দাখিল করে। সেখানে পূর্বনির্ধারিত একজনকে কার্যাদেশ দেয়া হয়।
প্যাকেজ জি ৬৬-২ এর মাধ্যমে ২৪১ মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিকের জন্য ছোট ফ্রিজ ও সার্জিক্যাল কিট ক্রয়ের দরপত্রে ছয়জন অংশ নিলেও একজনকে রেসপন্সিভ করে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়। ৫০ লিটারের ফ্রিজ নেওয়ার আদেশ হলেও সরবরাহ করা হয় ৪৫ লিটারের। যেসব সার্জিক্যাল কিট নেওয়া হয় সেগুলোও ছিল নিম্নমানের।
প্যাকেজ জি ২৮-২৯ এ ফিড কমপ্লিমেন্টারি ক্রয়ের জন্য ছয়জন দরপত্র কিনে চারজন অংশ নেয়। পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ করে প্রায় ৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। প্যাকেজ জি-১১৪ এর প্যাকেজ ফিড, মেডিসিন ও ভ্যাকনিস ক্রয়ের জন্য দরপত্রে চার প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। পছন্দের ঠিকাদারকে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এই প্যাকেজেও নি¤œমানের পণ্য সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে।
প্যাকেজ জি ১২১ এ সিঙ্গেল ইউনিট মিল্কিং মেশিন ক্রয়ের দরপত্রে পাঁচ প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও গোলাম রব্বানীর আত্মীয়কে প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
প্যাকেজ জি-৭০-এ কনজুমাবলস আইটেম ক্রয়ের দরপত্র দাখিল করা দুই জনের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত একজনকে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। জি-৮০-৮১তে ৪৬ ইউনিট লিকুইড সেপারেটর বা গ্যাস জেনারেটর ক্রয়ের জন্যও একইভাবে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। গত ২ আগস্ট মালামাল সরবরাহের মেয়াদ থাকলেও গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাটি মালামাল সরবাহ করেনি।
প্যাকেজ জি-৪২ এ ল্যাবরেটরির জন্য কনজুমাবলস আইটেম ক্রয়ের দরপত্র দেওয়া হয়। মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান সেখানে অংশ নেয়। তাদেরকে প্রায় এক কোটি ৬৭ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। প্যাকেজ ডি-৬২ তে ৬ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ দেখিয়ে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩ মাসের পরিবর্তে ৫ মাস সময় দেওয়া হয়।
প্যাকেজ জি-১৫-এর দরপত্রে অংশ নেওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটিকে রেসপন্সিভ দেখিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ঠিকাদার জনৈক ডিপিডির আত্মীয়।
প্যাকেজ জি-৪২ এ ল্যাবরেটরির জন্য কনজুমাবলস আইটেম ক্রয়ের দরপত্র দেওয়া হয়। মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান সেখানে অংশ নেয়। তাদেরকে প্রায় এক কোটি ৬৭ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। প্যাকেজ ডি-৬২ তে ৬ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ দেখিয়ে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩ মাসের পরিবর্তে ৫ মাস সময় দেওয়া হয়।
প্যাকেজ জি-১৫-এর দরপত্রে অংশ নেওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটিকে রেসপন্সিভ দেখিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ঠিকাদার জনৈক ডিপিডির আত্মীয়।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, ডিপিপির ব্যর্থয় ঘটিয়ে ক্রয় কমিটির অনুমোদন না নেওয়ার কৌশল হিসেবে একই আইটেমের জন্য তিনটি প্যাকেজ করা হয়েছে। প্যাকজ নং ৯৮, ৯৮-এ ও ৯৯; যা আর্থিক বিধির সুষ্পষ্ট লংঘন। প্রতিটি প্যাকেরজ মূল্য ৩৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা করে ৩ প্যাকেজে ১১১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়। অথচ এই পরিমান কার্যাদেশের জন্য মন্ত্রী পরিষদের ক্রয় কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন ছিলো। প্যাকেজ জি-৬২ এ উপজেলা মিনি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ল্যাবের জন্য কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয়ের আদেশ দেওয়া হয়। গত এপ্রিলে আহ্বান করা দরপত্রে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে।
কয়েকটি বাদে অধিকাংশ ল্যাব ব্যবহার উপযোগী না হওয়ায় কোটি কোটি টাকার দরপত্র বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। প্যাকেজ ৬৬ (২)-এর মাধ্যমে যেসব কার্যাদেশ দেওয়া হয় সেখান সংগ্রহ করার পণ্য স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হয়নি। প্রায় ২০ কোটি টাকার মিল্ক সেফারেটর মেশিন ও আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন ক্রয় ও সরবরাহ করা করা হয়েছে। মেশিনগুলো ব্যবহারের অনুপোযোগী। স্টিকার মারা মেশিনগুলো খুবই নিম্নমানের। গোলাম রব্বানী গংরা ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ আদায় করেছন। প্রকল্পের প্রতিটি কাজেই ওভার স্টেমেট করা হয়েছে।
এছাড়া, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে মাঠ সহকারী পদে রংপুর ও আশপাশের জেলার প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে আঞ্চলিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে। এমনকি, নিজের আত্মীয় সুমাইয়া ইসলামকে এলএমএ পদে নিয়োগ দিয়ে তিন বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও বেতন দেয়া হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে গাজীপুরে বদলি করা হয়।
সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রকল্পের ৯০ শতাংশ ম্যাচিং গ্রান্ট কেবল রংপুর অঞ্চলে বিতরণের বিষয়টি। কেন্দ্রীয় নীতিমালার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে এটি বাস্তবায়ন করেন গোলাম রাব্বানী।
প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের জন্য সিটিসি নিজের মতো করে শর্ত আরোপ করে চুক্তি সম্পাদন করেছেন, যা সরকারি ক্রয় নীতিমালার (পিপিআর) পরিপন্থী। ছাতা, চেয়ার, লাঠি কেনার নামে প্রতি বছর ১৮-২০ লাখ টাকা বিল করা হয়, যার বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
স্কুল মিল্ক প্রকল্পেও প্রতি প্যাকেট দুধ বাজার দরের থেকে দুই টাকা বেশি দামে কেনার পেছনেও এই রাব্বানীর নাম শোনা যায়।
প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ সময়ে এসে পিপিআর ভ্যাকসিনক্রয়, স্কুল ফিডিং ও পশুখাদ্য এবং যন্ত্রপাতিক্রয়সহ বেশকিছু ভুয়া কিছু আইটেম সংযোজনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পের টাকায় গোলাম রব্বানী চারবার ইউরোপ সফর করেছেন। স্থানীয় প্রশিক্ষনের নামে ব্যয় করা করেছেন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গোলাম রব্বানীর সাথে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।